গত ৫ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পরাজয়ের পর কঠিন সংকটে পড়েছে প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগ। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে আপাতত নিশ্চুপ থাকার কৌশল নিয়েছে দলটি। মূলত দলের কেন্দ্র থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের এখনো শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরই আস্থাভাজন। ফলে আপাতত দলের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আনছে আওয়ামী লীগ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুঞ্জন সভাপতি হামিদ, সম্পাদক আইভী : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাবেক রাষ্ট্রপতি এডভোকেট আবদুল হামিদ ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভীকে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিয়োগের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। তবে মামলা-হামলা থেকে বাঁচতে আত্মগোপনে থাকা দলের সিনিয়র নেতারা এই গুঞ্জনকে গুজব হিসেবে উড়িয়ে দিয়েছেন। ওইসব নেতাদের মতে, দলীয় নেতৃত্বের পরিবর্তনের কোনো পরিকল্পনা নেই। শেখ হাসিনা দলের সভাপতি এবং ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে থাকবেন। বর্তমানে দলের নেতাকর্মীদের মামলা ও হামলা থেকে নিরাপদে রাখা প্রধান লক্ষ্য। এ বিষয়ে কথা হয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল এর সঙ্গে। তিনি বলেন, দলীয় নেতৃত্বের পরিবর্তন নিয়ে আমরা ভাবছি না। আমরা এখন দলকে গোছানোর পরিকল্পনায় আছি। ফেসবুকে চলমান গুঞ্জন গুজব ছাড়া কিছু নয়।
হুটহাট নয়, পরিকল্পনা করে কর্মসূচি দিবে আ’লীগ : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একাধিক পোস্টে বলা হয়, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীকে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোশাররফ হোসেন এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজকে শীর্ষ নেতৃত্বে আনা হচ্ছে বলেও গুজব চলছে। এ বিষয়ে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রাখার আগে আমাদের কর্মীদের নিরাপদে রাখা জরুরি। বর্তমানে হামলা-মামলার মধ্যে থাকা কর্মীদের রক্ষা করা আমাদের প্রধান লক্ষ্য। আগের মতো হুটহাট কর্মসূচি দেয়া যাবে না, পরিকল্পনা করে কর্মসূচি হাতে নিতে হবে।
এদিকে, আওয়ামী লীগের একটি অংশ দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে পরিবর্তনের দাবি তুলছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক নেতা বলেন, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দায়ী। তার কথার লাগাম ছিল না। তার কারণে দলের এই পরিণতি। তার পরিবর্তে একজন জনপ্রিয় নেতাকে দায়িত্ব দিতে হবে। এখন অনেক নেতাই পলাতক রয়েছেন। সেক্ষেত্রে কর্মীদের সঙ্গে যিনি যোগাযোগ করতে পারবেন, এমন কোনো নেতার প্রয়োজন। তিনি বলেন, ২০০৭ সালের ১/১১’র সময় যেভাবে দলের হাল ধরেছিলেন তখনকার দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সেই আশরাফুলের মতো একজন নেতার খুব প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ এমন একজন নেতাকেই সাধারণ সম্পাদক হিসেবে খুঁজছে। প্রয়োজনে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে সাধারণ সম্পাদক পদের জন্য কাউকে দায়িত্ব দেয়া হবে। নেতারা আত্মগোপনে আছেন, কর্মীদের পাশে কেউ নেই। কর্মীদের সক্রিয় রাখতে হলে দেশের মধ্যে কাউকে না কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে হত্যা করা হয়। বিদেশে থাকায় বেঁচে যান তার দুই কন্যা, শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। বিদেশে থাকা অবস্থায় ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে শেখ হাসিনা দলের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ১৯৮১ সালে দলের অবস্থা বর্তমানে অপেক্ষাকৃত খারাপ ছিল। সেই সময় শেখ হাসিনাকে দলের হাল ধরতে হয়েছিল, এখনকার অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো।
নেতৃত্বশূন্যতায় রীতিমতো বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ : গত ৫ অগাস্ট গণ-আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। শীর্ষ নেতারাও অনেকে দেশ ছেড়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেউ কেউ ‘দেশ ছাড়ার চেষ্টাকালে’ গ্রেফতার হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী রাজনীতি ছাড়তে চান বলে বিসিসি বাংলা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে নেতাদের মধ্যে এখনও যারা দেশে অবস্থান করছেন, তাদের প্রায় সবাই ‘আত্মগোপন’ করেছেন। এমন অবস্থায় গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে চরম নেতৃত্বশূন্যতা দেখা দিয়েছে। এতে সাংগঠনিকভাবে দলটি রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাদের অনেকেই এখন উদ্বগ ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। কথা বলার সময় কেউ তাদের নামও প্রকাশ করতে চাননি। আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, আমাদের দলের এখন দিশেহারা বিপর্যস্ত অবস্থা হয়ে গেছে। একমাস হয়ে গেল অথচ কেন্দ্র থেকে কার্যকর কোনো নির্দেশনা দেয়া হলো না। ফোন দিলেও কেউ ধরে না। হামলা-মামলা সব মিলিয়ে নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নেতাকর্মীদের অনেকে রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগের এখনকার যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, সেটার জন্য দলের সিনিয়র নেতাদের দায়ী করছেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফরিদপুরের একজন আওয়ামী লীগ কর্মী বলেন, ক্ষমতা হারালে এমন অবস্থা যে হতে পারে, সেটা তো নেতাদের অজানা থাকার কথা না। তারাই তো এর জন্য দায়ী। ক্রিম খাইলো নেতারা, কোটি কোটি টাকা বানাইলো তারা, আর তাদের পাপের শাস্তি ভোগ করতে হইতেছে আমাদের মতো তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। তবে প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৫ আগস্টের পর গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বেশ সক্রিয় অবস্থানে দেখা গেলেও এখন আর সেটি চোখে পড়ছে। তবে পরিস্থিতি যত খারাপই হোক, আওয়ামী লীগ আবারও ঘুরে দাঁড়াবে বলে জানাচ্ছেন দলের শীর্ষ নেতারা। বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করা দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একাত্তর সালে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। কাজেই দেশ যতদিন থাকবে, আমাদের দলও থাকবে। আমরা আবারও ঘুরে দাঁড়াবো।
প্রসঙ্গত, সরকার পদত্যাগের একদফা দাবিতে তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। ফলে আওয়ামী লীগের টানা দেড় দশকের শাসনের অবসান ঘটে। সরকার পতনের কারণে রাজনৈতিকভাবে ভেঙে পড়া দলটিকে আবারও চাঙা করতে এবং সব নেতাকর্মীকে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন দলের হাইকমান্ড। এক্ষেত্রে ১৫ আগস্ট শোক দিবস ঘিরে পরিকল্পনা সাজিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু সেদিন কোনো নেতাকে মাঠে নামতে দেখা যায়নি। হাতেগোনা কয়েকজন ধানমন্ডি ৩২ নম্বর গেলেও ছাত্রদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। তারপর থেকেই অনেকটা নিশ্চুপ রয়েছে দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকা দলটির নেতাকর্মীরা।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

পরিবর্তন আনছে না আওয়ামী লীগ
- আপলোড সময় : ০৭-০৯-২০২৪ ০১:২৪:১৫ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৭-০৯-২০২৪ ০১:২৪:১৫ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ